এই পৃথিবীতে আমরা শান্তি চাই
আমরা এশিয়ার কৃষক
এই পৃথিবীতে আমরা শান্তি চাই
আমরা আফ্রিকার শ্রমিক
এই পৃথিবীতে আমরা শান্তি চাই
আমরা ইউরোপের শিশু
আমরা শান্তি চাই;
আমাদের সকলের সমবেত প্রার্থনা আজ – শান্তি ।
এই শান্তির জন্যে মিউনিখ শহরে তোলপাড় করেছি আমরা
এই শান্তির জন্যে ইতালির রাজপথে করেছি দীর্ঘ মিছিল
এই শান্তির জন্যে নিউইয়র্ক শহরে বিক্ষোভ করেছি অসংখ্য
মানুষ
এই শান্তির জন্যে আমরা আফ্রিকার শিশু
প্যালেস্টাইনের কিশোর আর নামিবিয়ার যুবক কতো বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি,
আবার এই শান্তির জন্যে বাংলার দুঃখিনী মায়ের চোখে
ঘুম নেই ।
সবুজ শস্যক্ষেত, সদ্যফোটা ফুল ও শিশুর
হাসির জন্যে
পৃথিবী জুড়ে আমরা চাই শাস্তিকল্যাণ । শাস্তি চাই যারা শিশুদের ভালোবাসি
শাস্তি চাই যারা রাজা গোলাপ ভালোবাসি:
শান্তি চাই যারা লুমুম্বা, আলেন্দে ও শেখ মুজিবের
নিষ্ঠুর মৃত্যুর জন্য কাঁদি
শান্তি চাই যারা পিকাসোর গোয়ের্নিকার কথা ভাবি
এই পৃথিবীতে আমরা শান্তি চাই—
শিশুদের পদধ্বনির মতো শান্তি
বকুল ঝরে পড়ার মতো শান্তি
রজনীগন্ধার খোলা পাপড়ির মতো শাস্তি ।
আমরা হিরোশিমা-নাগাসাকির ব্যথিত আত্মা
আমরা শান্তি চাই;
আমরা ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদ
আমরা শান্তি চাই;
আমরা শোকাহত মায়ের চোখের জল
বোনের ক্রন্দন, স্ত্রীর শোকাশ্র
আমরা শান্তি চাই;
আমরা কবিতা ভালোবাসি
আমরা শান্তি চাই;
আমরা শিল্প ও জীবন ভালোবাসি
আমরা শান্তি চাই;
আমরা এখনো মানুষের হৃদয় ও মনুষ্যত্বে
সমান বিশ্বাসী
আমরা শান্তি চাই ।
[সংক্ষেপিত]
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি মহাদেব সাহা ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পৈতৃক বাড়ি পাবনা জেলার ধানঘড়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম গদাধর সাহা এবং মায়ের নাম বিরাজমোহিনী সাহা। কবির শিক্ষাজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে বগুড়া এবং রাজশাহীতে । ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন ।
মহাদেব সাহার কবিতা মানবের সুখ ও দুঃখের এক চলমান উপাখ্যান । সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, রাজনীতি-মনস্কতা মহাদেব সাহাকে টেনে আনে মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস', ‘মানব এসেছি কাছে', 'চাই বিষ অমরতা', 'ফুল কই শুধু অস্ত্রের উল্লাস', 'কোথা প্রেম কোথা সে বিদ্রোহ', ‘বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ', ‘একবার নিজের কাছে যাই' প্রভৃতি । তিনি ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদকসহ আরও বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ।
মিউনিখ - জার্মানির বায়ার্ন রাজ্যের রাজধানী। জার্মান ভাষায় শহরটির নামের উচ্চারণ ম্যুনশেন। শহরটি ইসার নদীর তীরে বেভারীয় আল্পসের উত্তরে অবস্থিত । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসময়ে হিটলারের বিরুদ্ধে এই শহরে ছাত্র ও শিক্ষকরা এক অহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ।
নিউইয়র্ক - যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নিউইয়র্ক রাজ্যের সবচেয়ে বেশি জন- অধ্যুষিত মহানগর। জাতিসংঘের সদর দপ্তর হওয়াতে এ মহানগর বিশ্ব মানবের মিলন কেন্দ্রে পরিণত।
প্যালেস্টাইন - আরবি উচ্চারণে ফিলিস্তিন । ভূমধ্যসাগর এবং জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল । ইসরাইলের সঙ্গে এখনও এই অঞ্চলের জনগণের যুদ্ধ চলছে।
নামিবিয়া - আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের একটি দেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার শাসনের বিরুদ্ধে প্রায় চব্বিশ বছরব্যাপী দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গেরিলা যুদ্ধের পর ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে দেশটি স্বাধীন হয় ।
লুমুম্বা
প্যাট্রিস এমেরি লুমুম্বা; জন্ম দোসরা জুলাই ১৯২৫, মৃত্যু ১৭ই জানুয়ারি ১৯৬১। আফ্রিকার দেশ কঙ্গোর স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা এবং দেশটির প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতা লাভের মাত্র বারো সপ্তাহ পরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি নিহত হন ।
আলেন্দে - সালভাদর গুইলার্মো আলেন্দে গোসেন্স জন্ম ২৬৩ জুন ১৯০৮ এবং মৃত্যু ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৩। চিলির বামপন্থি নেতা এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম মার্কসবাদী রাষ্ট্রপতি। দেশ পরিচালনার নীতিসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থানে বন্দি হন। বন্দি অবস্থাতেই তিনি তাঁর শেষ ভাষণ দেন এবং পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে হত্যা করা হয়।
পিকাসো - পাবলো রুইজ ই পিকাসো জন্ম ২৫এ অক্টোবর ১৮৮১ এবং মৃত্যু ৮ই এপ্রিল ১৯৭৩। বিশ শতকের বিখ্যাত স্পেনীয় চিত্রশিল্পী। বিশ শতকের অন্যতম শিল্প-আন্দোলন কিউবিজমের অন্যতম প্রবক্তা। ওই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল আঁকা ছবিতে বিমূর্ততা সঞ্চার এবং ত্রিমাত্রিকতা যোজনা করা, যার সাহায্যে একটি ছবিকে বহু দৃষ্টিকোণে বিবেচনা করা যায় ।
গোর্নিকা - পিকাসোর একটি বিখ্যাত ছবি। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলাকালে উত্তর স্পেনের একটি ছোট শহর গোর্নিকায় জার্মান ও ইতালির মদদে বোমা হামলার প্রতিক্রিয়ায় এই ছবিটি তিনি আঁকেন। ছবিটিতে যুদ্ধের মর্মান্তিকতা এবং সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা ও অসহায়ত্বকে তুলে ধরা হয়।
“শান্তির গান” কবিতাটি কবি মহাদেব সাহার 'ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস' (১৯৮৪) গ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে । পৃথিবীব্যাপী মানুষের জন্য শান্তির অন্তহীন প্রত্যাশা নিয়ে কবি যে গান রচনা করে চলেন অবিরাম, তারই দ্যোতনা বহন করে আলোচ্য কবিতাটি । এ কবিতায় কবি ধাপে ধাপে তুলে ধরেছেন—কাদের জন্য এই জন্য, শান্তি, কেমন করে তারা শাস্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে, শান্তিকামী এই মানুষগুলোর মনস্তত্ত্বই বা কেমন। এক কথায় বলা যায় যে, কবির এই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা মূলত মেহনতি মানুষের জন্য, শিশুদের মনুষ্যত্ববোধে উদ্দীপ্ত সকলের জন্য । তাই কবি এশিয়ার কৃষক, আফ্রিকার শ্রমিক, ইউরোপের শিশু—সকলকে এই শাস্তি-পতাকার তলে সমবেত করতে চান । শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কবি এবং কবির মতো মানুষেরা লড়াই করেন; প্রতিবাদের ঝড় তোলেন মিউনিখ, নিউইয়র্কসহ ইতালির বিভিন্ন শহরের পথে পথে। কিন্তু শান্তি বিরোধীরাও থেমে থাকে না । তারা হয়ে ওঠে আরও হিংস্র, ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর। এইসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে, অশান্তির গর্জনকে থামিয়ে দিতে প্রয়োজন হয় সতর্ক প্রহরার । তাই যুগে যুগে আফ্রিকার শিশু, প্যালেস্টাইনের কিশোর, নামিবিয়ার যুবক এমনকি বাংলাদেশের দামাল মুক্তিযোদ্ধারা নির্ঘুম রাত জেগে হয়ে ওঠে শান্তির প্রহরী । একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন 'একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করেছিল, তেমনি এই শান্তির সেনানীরা 'শস্যক্ষেত, সদ্যফোটা ফুল, শিশুর হাসির জন্যে' শান্তি চায়। এই শান্তির পক্ষের মানুষগুলোর মন হয় কোমল, হৃদয়জুড়ে থাকে অফুরান আবেগ। তাই তারা লুমুম্বা, আলেন্দে, শেখ মুজিবের নির্মম হত্যাকাণ্ডে অশ্রুসিক্ত হয়, পিকাসোর প্যের্নিকা তাদের আবেগাপ্লুত করে ।
কবিতাটি বিবৃতিধর্মী; বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কবি একের পর এক স্বভাবোক্তি করে চলেন । কেননা, কবি জানেন, প্রতিবাদের কথা, প্রত্যাশার কথা বলতে হয় সরাসরি স্পষ্টভাবে। তিনটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে বলা যায়, অলংকারসমৃদ্ধ কবিতা রচনার প্রচল রীতি থেকে মহাদেব সাহা এই কবিতায় বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। যা তিনি বলতে চান তাতে কোনো আড়াল রাখার পক্ষে তিনি নন । কবি মানুষের দুঃখের কথা বেদনার কথা আশার কথা প্রত্যাশার কথা তুলে ধরার জন্য গদ্যের সহজ ভঙ্গি কবিতায় ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কবিতাটিকে নিবিড়ভাবে বাস্তবঘনিষ্ঠ করে তুলতে তিনি ব্যবহার করেন অনেক ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ। পৃথিবীর চেনা ভূগোলকে তিনি কাব্যিক পেলবতায় পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন । আর এরই সঙ্গে কবি অন্তর্বয়ন ঘটান ‘বকুলের ঝরে পড়ার মতো শান্তি', 'রজনীগন্ধার খোলা পাপড়ির মতো শান্তি - এরকম উপমামণ্ডিত
নান্দনিক আবহসমৃদ্ধ পঙ্ক্তিমালা । এভাবে কবিতাটি বিষয়ে ও আঙ্গিকে বিশেষ তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে । কবিতাটি গদ্যছন্দের চাল অনুসরণ করে রচিত । অন্ত্যমিলবিহীন ছোটবড় পঙ্ক্তিতে কবিতাটির কাঠামো গড়ে উঠেছে ।
আরও দেখুন...